6/recent/ticker-posts

বোবায় ধরা কী? বিজ্ঞান কী বলে?

বোবায় ধরা কী? বিজ্ঞান কী বলে?

 


ভূমিকা

রাতে ঘুমের মধ্যে হঠাৎ করে জেগে উঠে দেখা যায়, শরীর একদম নাড়ানো যাচ্ছে না। গলার স্বর যেন আটকে গেছে, চিৎকার করলেও কেউ শুনতে পায় না। বুকের উপর ভারী কিছু বসে আছে মনে হয়, আর নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। কেউ কেউ মনে করেন, কেউ বা কিছু ঘাড়ে চেপে বসেছে। এই অভিজ্ঞতাটি যেকোনো মানুষের জন্য ভীতিকর। বাংলা ভাষায় একে বলা হয় "বোবায় ধরা"। তবে বিজ্ঞানের ভাষায় এর নাম Sleep Paralysis বা ঘুমে পক্ষাঘাত

এই প্রবন্ধে আমরা জানবো—

  1. বোবায় ধরা কী?

  2. কীভাবে ও কেন এটি ঘটে?

  3. এর পিছনের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা কী?

  4. ভৌতিক বিশ্বাস ও কুসংস্কার

  5. প্রতিরোধ ও চিকিৎসা

  6. মানসিক প্রভাব ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি


১. বোবায় ধরা: একটি প্রাচীন অভিজ্ঞতা

"বোবায় ধরা" শব্দটি বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে নানা নামে পরিচিত। কেউ বলে "বোক চাপা", কেউ বলে "ভূতে ধরা", কেউ বলে "আত্মা ঘাড়ে চেপেছে"। বাংলাদেশের মতো ভারতের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল এবং অন্যান্য দেশেও এই অভিজ্ঞতা বহু মানুষের মধ্যেই দেখা যায়। এটি সাধারণত রাতে অথবা ভোরবেলা ঘটে এবং কয়েক সেকেন্ড থেকে কয়েক মিনিট পর্যন্ত স্থায়ী হয়।

এই অবস্থায়—

  • মানুষ সম্পূর্ণ সচেতন থাকে,

  • চোখ খোলা থাকে বা খোলার চেষ্টা করে,

  • কিন্তু শরীর নাড়াতে পারে না,

  • অনেক সময় ভয়ানক স্বপ্ন বা কল্পনার মধ্যে পড়ে,

  • বুকের ওপর চাপ অনুভব করে।


২. Sleep Paralysis: বৈজ্ঞানিক সংজ্ঞা

Sleep Paralysis হলো এক ধরণের ঘুমজনিত সমস্যা যেখানে ব্যক্তি ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়ার সময় বা ঘুমাতে যাওয়ার সময় শরীরকে নড়াতে পারে না, অথচ চেতনা সচল থাকে।

এটি হয় মূলত REM (Rapid Eye Movement) ঘুমের সময়। REM ঘুমেই মানুষ বেশি স্বপ্ন দেখে। এই পর্যায়ে মস্তিষ্ক শরীরকে সাময়িক পক্ষাঘাতগ্রস্ত করে রাখে যাতে স্বপ্নে দেখা কাজ বাস্তবে না হয়। কিন্তু যদি মস্তিষ্ক জেগে ওঠে আর শরীর তখনো সেই পক্ষাঘাতে থাকে, তখনই ঘটে Sleep Paralysis।


৩. বোবায় ধরা হওয়ার কারণ

Sleep Paralysis-এর কারণগুলো মূলত ঘুমের অভ্যন্তরীণ সমস্যা এবং কিছু বাইরের প্রভাবের ফলাফল। যেমন:

i. ঘুমের অভাব

অপর্যাপ্ত বা খারাপ ঘুম Sleep Paralysis-এর একটি বড় কারণ।

ii. অনিয়মিত ঘুমের সময়সূচি

ঘুমের রুটিন না থাকলে শরীর ও মস্তিষ্কের ঘুমের ধাপ গুলিয়ে যায়।

iii. মানসিক চাপ ও উদ্বেগ

অতিরিক্ত মানসিক চাপ, দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ ঘুমের ওপর প্রভাব ফেলে।

iv. পারিবারিক ইতিহাস

পরিবারে কারও Sleep Paralysis থাকলে, অন্যদের মধ্যেও হতে পারে।

v. স্নায়ুবিক রোগ

নারকোলেপসি (Narcolepsy)-র মতো ঘুমের ব্যাধির সঙ্গে Sleep Paralysis যুক্ত থাকতে পারে।

vi. ঘুমানোর ভঙ্গি

চিৎ হয়ে ঘুমালে এই সমস্যা বেশি দেখা যায়।


৪. বোবায় ধরার সময় যা ঘটে

Sleep Paralysis-এর সময় আমাদের মস্তিষ্ক REM ঘুম থেকে জেগে ওঠে, কিন্তু শরীর সেই অবস্থায় থেকে যায়। তখন নিচের ধাপগুলো ঘটে:

  • চেতনা সচল থাকে – মানুষ আশেপাশের পরিবেশ বুঝতে পারে।

  • মাংসপেশী নড়াচড়া বন্ধ থাকে – স্বেচ্ছা চলাচল সম্ভব হয় না।

  • ভয়ের অনুভব হয় – অনেক সময় কল্পনাতে অদ্ভুত বা ভীতিকর কিছু দেখা যায়।

  • হ্যালুসিনেশন হয় – কেউ কেউ মনে করেন কেউ বা কিছু পাশে দাঁড়িয়ে আছে, ঘাড়ে বসে আছে বা ধরা দিয়েছে।


৫. ভৌতিক ব্যাখ্যা ও কুসংস্কার

বাংলা সংস্কৃতিতে বোবায় ধরা এক ধরণের অতিপ্রাকৃত ঘটনা হিসেবে বিবেচিত। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে অনেকে বিশ্বাস করেন যে:

  • এটি ভূতের কাজ,

  • শত্রুদের পাঠানো আত্মা ঘাড়ে চাপে,

  • কোনো অশরীরী আত্মা শরীর দখল করতে চায়।

এমনকি বিভিন্ন ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যাও জুড়ে দেওয়া হয়, যেমন—

  • জ্বিন দ্বারা আক্রমণ,

  • পাপের ফল,

  • দুষ্ট আত্মার ছায়া।

এই ধরনের কুসংস্কার আজও অনেক মানুষের মধ্যে প্রচলিত আছে। তবে বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এগুলো মস্তিষ্কের ভুল ব্যাখ্যা।


৬. হ্যালুসিনেশন: চোখের সামনে অদৃশ্য জগত?

Sleep Paralysis-এর সময় অনেকেই বলে থাকেন, তারা—

  • অন্ধকার ছায়া দেখেন,

  • কারো নিঃশ্বাস বা কণ্ঠস্বর শুনতে পান,

  • কারো উপস্থিতি অনুভব করেন।

এগুলো সবই হ্যালুসিনেশন বা মস্তিষ্কের তৈরি ভ্রান্ত অনুভুতি।

বিজ্ঞানীরা বলেন, REM ঘুমের সময় আমাদের মস্তিষ্ক ‘dream state’-এ থাকে। তাই হঠাৎ জেগে উঠলে সেই স্বপ্নের অংশগুলো বাস্তব মনে হয় এবং ভয়াবহ রূপ নেয়।


৭. Sleep Paralysis-এর বৈজ্ঞানিক গবেষণা

বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন গবেষণায় জানা গেছে:

  • প্রায় ৮% থেকে ৫০% মানুষ জীবনে অন্তত একবার এই অভিজ্ঞতা লাভ করে।

  • সবচেয়ে বেশি হয় ২০-৩০ বছর বয়সীদের মধ্যে।

  • মানসিক রোগে আক্রান্ত, যেমন PTSD, উদ্বেগ, বিষণ্ণতায় ভোগা ব্যক্তিদের মধ্যে এর হার বেশি।

নিউরোসায়েন্স অনুযায়ী, Sleep Paralysis হলো মস্তিষ্কের ‘REM-off’ এবং ‘wake-on’ সিগনালের ভুল সমন্বয়ের ফল।


৮. Sleep Paralysis ও ধর্মীয় অভিজ্ঞতা

বিভিন্ন ধর্মে Sleep Paralysis-এর সময়কার অনুভূতিকে অতিপ্রাকৃত বলে মনে করা হয়। যেমন:

  • ইসলামে একে জ্বিন দ্বারা আক্রমণ বলা হয়।

  • খ্রিস্ট ধর্মে শয়তানের চাপ হিসেবে দেখা হয়।

  • হিন্দু ধর্মে দেবতা বা অশুভ আত্মার প্রভাব হিসেবে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়।

তবে ধর্মীয় অনুভূতির পেছনে ঘুমের অসঙ্গতি ও মানসিক উপাদান কাজ করে থাকে।


৯. প্রতিরোধ ও করণীয়

Sleep Paralysis চিকিৎসা না লাগলেও কিছু নিয়ম মানলে এড়ানো সম্ভব:

i. ঘুমের রুটিন তৈরি করুন

প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমাতে যান ও উঠুন।

ii. ঘুমের সময় ৭-৮ ঘণ্টা নিশ্চিত করুন

iii. চিৎ হয়ে না ঘুমিয়ে পাশ ফিরে ঘুমান

iv. মানসিক চাপ কমান

ধ্যান, মেডিটেশন, হালকা ব্যায়াম মানসিক চাপ কমায়।

v. ক্যাফেইন ও মদ্যপান কমান

vi. প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন

Sleep Disorder বা Mental Health Specialist-এর কাছে যান যদি ঘটনা ঘন ঘন ঘটে।


১০. চিকিৎসা পদ্ধতি

Sleep Paralysis যদি খুব ঘন ঘন হতে থাকে বা মানসিকভাবে ক্ষতি করে, তাহলে চিকিৎসা দরকার হতে পারে। যেমন:

  • Cognitive Behavioral Therapy (CBT) – মানসিক অবস্থা উন্নয়নের জন্য।

  • Antidepressants – REM ঘুম কমাতে ব্যবহৃত হয়।

  • Sleep Study (Polysomnography) – ঘুমের পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে সমস্যার উৎস খোঁজা হয়।


১১. সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ও মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব

Sleep Paralysis অনেক সময় ব্যক্তিকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে। ভয়, উদ্বেগ, ঘুমের ভীতি এমনকি বিষণ্ণতার দিকে ঠেলে দেয়। এছাড়া যারা এটি বোঝে না, তারা ভিক্টিমকে ভুতে পেয়ে গেছে বলে কুসংস্কারে বিশ্বাস করে, যা পরিস্থিতি আরও খারাপ করে তোলে।

সচেতনতা, বৈজ্ঞানিক জ্ঞান এবং সহমর্মিতা এই বিষয়ে সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে।


১২. বোবায় ধরা: ভয়ের কিছু নয়

Sleep Paralysis একটি সাধারণ ঘুমজনিত সমস্যা। এটি জীবনঘাতী নয়, এবং ভয় পাওয়ার মতোও নয়। তবে কুসংস্কার ও অজ্ঞানতা থেকে এটি অনেক সময় আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আমরা যদি বুঝতে পারি যে এটি একটি বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা রয়েছে এমন অবস্থা, তাহলে ভয় কাটিয়ে উঠা সহজ হয়।


উপসংহার

“বোবায় ধরা” নিয়ে বহু বছর ধরে নানা গল্প, গুজব, বিশ্বাস প্রচলিত। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান বলছে, এটি একটি পরিচিত ঘুমজনিত ঘটনা যার জন্য ভয় পাওয়ার দরকার নেই। বরং সঠিক ঘুম, মানসিক শান্তি এবং নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপন এর প্রতিরোধে কার্যকর।

সমাজে এই বিষয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়া জরুরি, যাতে মানুষ অন্ধ বিশ্বাস নয়, বাস্তবতা ও যুক্তিকে গুরুত্ব দেয়।

Post a Comment

0 Comments