ক্লোনিং (Cloning) – হুবহু মানুষ তৈরি করার বিজ্ঞান
"হুবহু মানুষ" তৈরির সবচেয়ে কাছাকাছি ধারণা হলো ক্লোনিং। ক্লোনিং হলো জিনগতভাবে (genetically) একই প্রাণী বা মানুষ তৈরি করা।
কীভাবে ক্লোন করা হয়?
মানব ক্লোনিং এখনো গবেষণার পর্যায়ে রয়েছে, তবে পশুদের ক্ষেত্রে ক্লোনিং সফল হয়েছে (যেমন: ভেড়া 'ডলি')। প্রক্রিয়াটি সাধারণত এরকম:
-
একটি মানুষের কোষ (সোমাটিক সেল) নেওয়া হয়।
-
একটি ডিম্বাণু (egg cell) থেকে তার নিউক্লিয়াস (DNA) সরিয়ে ফেলা হয়।
-
সেই ডিম্বাণুতে আগের মানুষের কোষের নিউক্লিয়াস ঢুকিয়ে দেওয়া হয়।
-
এটি তখন একটি ভ্রূণ (embryo) হিসেবে গড়ে ওঠে এবং মাতৃগর্ভে প্রতিস্থাপন করা হয়।
-
জন্ম নেয় জিনগতভাবে হুবহু সেই মানুষের মতো একটি শিশু।
সমস্যা ও সীমাবদ্ধতা:
-
ক্লোন ব্যক্তি দেখতে হয়তো একরকম হবে, কিন্তু স্মৃতি, অভিজ্ঞতা, চিন্তাভাবনা আলাদা হবে।
-
নৈতিক, সামাজিক এবং আইনগত দিক থেকে মানব ক্লোনিং বহু দেশে নিষিদ্ধ।
-
মানুষের মন ও আচরণ শুধু DNA দিয়ে নির্ধারিত হয় না — পরিবেশ, শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা অনেক বড় ভূমিকা রাখে।
তাহলে হুবহু মানুষ সম্ভব নয়?
-
শরীর বা চেহারা হয়তো মিলানো সম্ভব (যেমন: জমজ ভাই বা ক্লোন)।
-
কিন্তু ব্যক্তিত্ব, মস্তিষ্কের চিন্তাধারা, অভ্যাস, আবেগ — এগুলো হুবহু নকল করা এখনো অসম্ভব।
অধ্যায়ঃ
পরিচিতি ও পটভূমি
জিনতত্ত্ব ও মানব দেহের গঠন
ক্লোনিং কী এবং এটি কীভাবে কাজ করে
পশু ক্লোনিংয়ের সাফল্য ও উদাহরণ
মানব ক্লোনিংয়ের সম্ভাবনা, সীমাবদ্ধতা ও চ্যালেঞ্জ
জিনগত মিল থাকা সত্ত্বেও পার্থক্যের কারণ
নৈতিক, আইনগত ও সামাজিক দিকভবিষ্যৎ সম্ভাবনা ও উপসংহার
একজন মানুষের থেকে হুবহু আরেকজন মানুষ তৈরি করা – বিজ্ঞানের বাস্তব দৃষ্টিকোণ থেকে
১. ভূমিকা
মানুষ চিরকালই অমরত্ব, নিয়ন্ত্রণ, এবং পুনর্নির্মাণের স্বপ্ন দেখে এসেছে। বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষ আজ এমন প্রশ্ন তুলছে, যা একসময় কল্পকাহিনির বিষয় ছিল। “একজন মানুষের থেকে হুবহু আরেকজন মানুষ তৈরি করা সম্ভব কি না?” — এমন প্রশ্ন আজ শুধু সিনেমার পর্দায় নয়, গবেষণাগারেও উচ্চারিত হচ্ছে। এই প্রবন্ধে আমরা বিজ্ঞানের চোখে এই ধারণাটি বিশ্লেষণ করব — এটি কতটা সম্ভব, কীভাবে করা যায়, এবং এর সীমাবদ্ধতাগুলো কী।
২. মানবদেহ ও জিনতত্ত্ব: একটি সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা
একজন মানুষ গঠিত হয় প্রায় ৩০ ট্রিলিয়ন কোষ নিয়ে, এবং প্রতিটি কোষের কেন্দ্রে থাকে ডিএনএ (DNA) নামক অণু। এই ডিএনএ-ই আমাদের চেহারা, রং, উচ্চতা, রোগপ্রবণতা, এমনকি কিছু মানসিক বৈশিষ্ট্যও নির্ধারণ করে। মানুষের দেহে ২৩ জোড়া ক্রোমোজোম থাকে, যেখানে ছড়িয়ে থাকে প্রায় ২০,০০০–২৫,০০০ জিন। এই জিনগুলোর মধ্যেই লুকিয়ে থাকে আমাদের পরিচয়।
ডিএনএ-কে যদি একটা "জীব বৈজ্ঞানিক ব্লুপ্রিন্ট" বলা হয়, তাহলে বলা চলে এই ব্লুপ্রিন্ট হুবহু কপি করে আরেকটা শরীর বানানো সম্ভব — তাত্ত্বিকভাবে।
তবে শুধু ডিএনএ-ই আমাদের গঠন করে না। পরিবেশ, অভিজ্ঞতা, শিক্ষা, এবং সামাজিক যোগাযোগ — সব মিলিয়ে গড়ে ওঠে একটি মানুষ। তাই শুধু জিনগত মিল থাকলেই "একই মানুষ" জন্মায় না।
৩. ক্লোনিং: হুবহু কপি করার পদ্ধতি
ক্লোনিং হলো একটি জীবের জিনগত প্রতিলিপি তৈরি করার প্রক্রিয়া। বিজ্ঞানীরা ইতিমধ্যে গরু, ভেড়া, বিড়াল, কুকুর ইত্যাদি প্রাণী সফলভাবে ক্লোন করেছেন।
সবচেয়ে বিখ্যাত ক্লোনড প্রাণী হলো ভেড়া 'ডলি', যাকে ১৯৯৬ সালে স্কটল্যান্ডে ক্লোন করা হয়েছিল।
ক্লোনিংয়ের ধাপসমূহ:
-
ডোনার কোষ সংগ্রহ: কোনো ব্যক্তির শরীরের একটি কোষ নেওয়া হয়। এটি হতে পারে ত্বক বা যেকোনো দেহকোষ (somatic cell)।
-
ডিম্বাণু প্রস্তুত: অন্য একটি নারীর ডিম্বাণু থেকে তার নিজস্ব নিউক্লিয়াস (যেখানে ডিএনএ থাকে) বের করে ফেলা হয়।
-
নিউক্লিয়াস প্রতিস্থাপন: সেই ডিম্বাণুতে ডোনারের কোষের নিউক্লিয়াস বসানো হয়।
-
বিদ্যুৎ বা রাসায়নিক উদ্দীপনায় ভ্রূণ গঠন: এই কৃত্রিম কোষকে উন্নীত করে ভ্রূণ তৈরি করা হয়।
-
গর্ভে প্রতিস্থাপন: এটি একটি মহিলার জরায়ুতে স্থাপন করা হয় এবং সেখান থেকে স্বাভাবিক গর্ভধারণের মাধ্যমে শিশু জন্ম নেয়।
এই প্রক্রিয়ায় জন্ম নেওয়া শিশু হবে জিনগতভাবে ডোনার ব্যক্তির হুবহু।
৪. পশু ক্লোনিং: সাফল্য, প্রয়োগ ও সীমাবদ্ধতা
১৯৯৬ সালে স্কটল্যান্ডের রোসলিন ইনস্টিটিউটে বিজ্ঞানীরা প্রথমবারের মতো একটি স্তন্যপায়ী প্রাণী সফলভাবে ক্লোন করেন। সেই ভেড়ার নাম ছিল 'ডলি', এবং এটি ছিল বৈজ্ঞানিক ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা। ডলিকে একটি প্রাপ্তবয়স্ক ভেড়ার স্তন কোষ থেকে তৈরি করা হয়েছিল — যেটা আগে কখনও হয়নি।
ডলির জন্ম বিজ্ঞানীদের দেখিয়ে দেয়, একটি পরিণত কোষ থেকেও পুরো শরীর তৈরি করা সম্ভব, যদি উপযুক্ত পরিবেশে সেটিকে ভ্রূণে রূপান্তরিত করা যায়।
ডলির পর অন্যান্য ক্লোনিংয়ের সাফল্য:
-
গরু – উচ্চ দুধদায়ী জাত সংরক্ষণের জন্য।
-
ঘোড়া – খেলার উপযোগী জাত রক্ষার্থে।
-
কুকুর – পোষা প্রাণীর “অনুরূপ” তৈরিতে।
-
বিড়াল – ‘সিসি’ নামের প্রথম ক্লোন বিড়াল, ২০০১ সালে।
-
বানর – ২০১৮ সালে চীন সফলভাবে ক্লোন করে দুটি বানর।
এইসব গবেষণা প্রমাণ করে, ক্লোনিং একটি বৈজ্ঞানিকভাবে বাস্তব প্রক্রিয়া — অন্তত প্রাণীদের ক্ষেত্রে। তবে এসব প্রাণীর মধ্যে অনেকেই স্বাস্থ্যগত সমস্যায় ভুগেছে, এবং আয়ু তুলনামূলক কম ছিল।
৫. মানব ক্লোনিং: সম্ভাবনা ও সীমাবদ্ধতা
যদিও বিজ্ঞানীরা প্রাণীদের ক্ষেত্রে ক্লোনিং সফলভাবে প্রয়োগ করেছেন, মানব ক্লোনিংয়ের বিষয়টি অনেক জটিল এবং বিতর্কিত।
৫.১. বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জ:
-
জিনগত ত্রুটি: ক্লোনিংয়ের সময় DNA-এর ক্ষতি বা পরিবর্তন হওয়ার ঝুঁকি থাকে, যা শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ও রোগপ্রবণতাকে প্রভাবিত করতে পারে।
-
সফলতার হার খুব কম: ডলির জন্য প্রায় ২৭৭টি ভ্রূণ তৈরি করতে হয়েছিল, যার মধ্যে মাত্র ১টি সফল হয়েছিল। এই হার মানুষে প্রয়োগ করা অসম্ভবরকম ঝুঁকিপূর্ণ।
-
উন্নত গর্ভাধান প্রযুক্তি দরকার: মানুষের জরায়ুতে কৃত্রিম ভ্রূণ প্রতিস্থাপন করে সফল জন্ম ঘটানো অনেক জটিল।
৫.২. মানবিক ও নৈতিক জটিলতা:
-
একটি ক্লোন শিশু কি একজন "মানুষ" হিসেবে সমান অধিকার পাবে?
-
যদি কোনো ব্যক্তি নিজের জন্য হুবহু আরেকজন তৈরি করেন, তবে সে কি শুধু “প্রতিলিপি” হিসেবে গড়া হবে?
-
কার উপর মালিকানা থাকবে? ক্লোন কি নিজের স্বাধীন ইচ্ছায় চলতে পারবে?
এসব প্রশ্নের উত্তর এখনো বিজ্ঞান বা সমাজ দিতে পারেনি।
৫.৩. আইনগত প্রতিবন্ধকতা:
বিশ্বের বেশিরভাগ দেশেই মানব ক্লোনিং নিষিদ্ধ বা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত। যেমন:
-
জাতিসংঘ ২০০৫ সালে মানব ক্লোনিংয়ের বিরুদ্ধে একটি ঘোষণাপত্র গ্রহণ করে।
-
যুক্তরাষ্ট্রে মানব ক্লোনিং সরকারি তহবিল দিয়ে করা নিষিদ্ধ।
-
ইউরোপীয় ইউনিয়ন–এর বহু দেশ মানব ক্লোনিংকে অবৈধ ঘোষণা করেছে।
৬. হুবহু মানুষ তাও এক নয়: অভিজ্ঞতা, পরিবেশ ও মস্তিষ্কের ভূমিকা
ধরুন, একজন ব্যক্তি তার নিজের ক্লোন তৈরি করল — তাহলে কি সেই ক্লোন হুবহু তার মতো হবে?
না, হবে না। কেন?
৬.১. অভিজ্ঞতা ও পরিবেশের প্রভাব:
একই ডিএনএ থাকার অর্থ একই চেহারা ও কিছু জৈবিক বৈশিষ্ট্য — কিন্তু ব্যক্তিত্ব, অভ্যাস, এবং চিন্তাধারা শুধু জিনের দ্বারা নির্ধারিত হয় না। উদাহরণস্বরূপ:
-
জমজ ভাই-বোন, যাদের জিন এক, তবুও তারা স্বভাবে ভিন্ন।
-
যেই পরিবেশে কেউ বড় হয় — পরিবারের আচরণ, সমাজের রীতি, শিক্ষার ধরন — সব কিছুই তার চরিত্র গঠনে ভূমিকা রাখে।
৬.২. মস্তিষ্কের নিউরন সংযোগ:
প্রতিটি মানুষের মস্তিষ্কের নিউরন সংযোগ হয় তার জীবনের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী। একই ব্যক্তি হলেও, ক্লোন হওয়ার পর যদি ভিন্ন পরিবেশে বড় হয়, তবে তার মস্তিষ্কের গঠন ও চিন্তাভাবনা সম্পূর্ণ আলাদা হবে।
৬.৩. স্মৃতি ও চেতনার হুবহু কপি সম্ভব নয়:
ডিএনএ-তে কোনো ব্যক্তির স্মৃতি বা চেতনা থাকে না। তাই ক্লোন ব্যক্তির স্মৃতিতে থাকবে না আসল ব্যক্তির কোনো অভিজ্ঞতা বা অনুভূতি। সে জন্মাবে একেবারে “নতুন” এক ব্যক্তি হিসেবে, যদিও চেহারায় একরকম।
৭. মানব ক্লোনিং নিয়ে নৈতিক, সামাজিক ও আইনগত বিতর্ক
মানব ক্লোনিং নিয়ে সবচেয়ে বড় প্রশ্নগুলোর একটি হলো – এটা কি করা উচিত?
বিজ্ঞান অনেক কিছু করতে পারে, কিন্তু "সব কিছু করাই কি নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য?" — এই প্রশ্নটাই মূল।
৭.১. নৈতিক (Ethical) প্রশ্ন:
ক) ক্লোন কি মানুষ?
একটি ক্লোন শিশুকে যদি শুধু একটি উদ্দেশ্য নিয়ে তৈরি করা হয় — যেমন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দান বা একজন মারা যাওয়া ব্যক্তির প্রতিস্থাপন — তাহলে সেই শিশুকে আমরা কীভাবে মূল্যায়ন করব?
সে কি পূর্ণ অধিকারসম্পন্ন মানুষ, নাকি একটি "জৈব বস্তু"?
খ) ব্যক্তিস্বাধীনতা:
প্রত্যেক মানুষের নিজস্ব চিন্তা, ইচ্ছা, জীবনধারা থাকে। ক্লোন যদি তার নিজের মতো করে বাঁচতে না পারে, বরং কেবল অন্যের প্রতিচ্ছবি হয়ে থাকে, তবে তা একটি নৃশংসতা।
গ) জীবনের প্রতি অসম্মান:
ক্লোনিংকে অনেকেই বলেন "ঈশ্বরের কাজে হস্তক্ষেপ", যেখানে জীবন সৃষ্টি হচ্ছে মানুষের হাত ধরে, প্রাকৃতিক নিয়মের বাইরে গিয়ে।
৭.২. সামাজিক প্রশ্ন:
ক) সমাজে বিভাজন সৃষ্টি:
যদি ধনী মানুষরা নিজেদের ক্লোন তৈরি করতে শুরু করে, তাহলে সমাজে এক ধরণের জৈব বৈষম্য তৈরি হবে। বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত ক্লোন বনাম সাধারণ মানুষ — এটা একধরনের সামাজিক সমস্যা ডেকে আনতে পারে।
খ) পরিচয় সংকট:
ক্লোন মানুষ তাদের স্বকীয়তা নিয়ে সমস্যায় পড়তে পারে। তারা সবসময় ভাববে, “আমি কি আসল মানুষ, নাকি কারো প্রতিলিপি?” — এটি মানসিক সমস্যারও জন্ম দিতে পারে।
গ) অপরাধমূলক প্রয়োগ:
কোনো অপরাধী যদি নিজের ক্লোন তৈরি করে রাখে, আইন প্রয়োগে তার চিহ্নিতকরণ কঠিন হতে পারে। এটি জৈব প্রযুক্তির অপব্যবহারের দ্বার খুলে দিতে পারে।
৭.৩. আইনগত অবস্থান:
বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই মানব ক্লোনিং নিষিদ্ধ বা সীমিত। কিছু গুরুত্বপূর্ণ আইন:
-
জাতিসংঘ (UN): ২০০৫ সালে মানব ক্লোনিংকে নিষিদ্ধ করার জন্য সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে আহ্বান জানায়।
-
ফ্রান্স: মানব ক্লোনিং একটি "অপরাধ" হিসেবে বিবেচনা করে, যার শাস্তি ২০ বছর পর্যন্ত জেল।
-
যুক্তরাষ্ট্র: মানব ক্লোনিংয়ে সরকারি অর্থায়ন নিষিদ্ধ, তবে বেসরকারি গবেষণার কোনো কেন্দ্রীয় আইন নেই।
-
জার্মানি, ইতালি, কানাডা: মানব ক্লোনিং পুরোপুরি বেআইনি।
বাংলাদেশে এই বিষয়ে সরাসরি কোনো আইন নেই, তবে জীবন ও মানবাধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে ক্লোনিংকে গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচনা করা হয় না।
৮. বর্তমান গবেষণা ও বৈজ্ঞানিক অবস্থান
মানব ক্লোনিং এখনো গবেষণার পর্যায়ে থাকলেও বিজ্ঞানীরা কিছু গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি অর্জন করেছেন।
৮.১. স্টেম সেল ক্লোনিং (Therapeutic Cloning):
এটি এমন এক ধরণের ক্লোনিং, যেখানে কোনো ব্যক্তির স্টেম সেল থেকে তার জন্য চিকিৎসা পদ্ধতি তৈরি করা হয় — যেমন অঙ্গ প্রতিস্থাপন, স্নায়ু রোগ নিরাময় ইত্যাদি।
এই প্রক্রিয়ায় একটি ভ্রূণ তৈরি করা হলেও, তা পূর্ণ মানব শিশুতে পরিণত করা হয় না — বরং তা থেকে কোষ সংগ্রহ করেই গবেষণা শেষ হয়।
৮.২. iPSC (Induced Pluripotent Stem Cells):
জাপানি বিজ্ঞানী শিনিয়া ইয়ামানাকা ২০০৬ সালে দেখিয়েছিলেন কীভাবে কোনো প্রাপ্তবয়স্ক কোষকে স্টেম সেলে পরিণত করা যায়। এর ফলে, ক্লোনিং ছাড়াও কোষ পুনর্গঠনের দরজা খুলে যায়।
৮.৩. চীনে বানরের ক্লোনিং:
২০১৮ সালে চীনা বিজ্ঞানীরা 'জং জং' ও 'হুয়া হুয়া' নামের দুইটি বানর ক্লোন করতে সক্ষম হন। যেহেতু বানর আমাদের জিনগতভাবে সবচেয়ে কাছাকাছি, তাই এটি মানব ক্লোনিংয়ের দিকে এক ধাপ এগিয়ে যাওয়া বলেই অনেকে মনে করেন।
তবে এখানেও প্রশ্ন ওঠে — “সফলতার হার এত কম হলে, মানুষ নিয়ে পরীক্ষা চালানো কি নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য?”
৯. ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা ও উপসংহার
৯.১. ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা:
মানব ক্লোনিং নিয়ে গবেষণা থেমে নেই। ভবিষ্যতে হয়তো প্রযুক্তি এতটাই উন্নত হবে, যেখানে:
-
সফলতার হার বেড়ে যাবে
-
জিনগত ত্রুটি দূর করা সম্ভব হবে
-
ক্লোনদের জন্য মানসিক সহায়তা ব্যবস্থা তৈরি হবে
তবে সমাজ, আইন ও নৈতিকতার সামঞ্জস্য না থাকলে এই প্রযুক্তি বিপদও ডেকে আনতে পারে।
৯.২. জিনগত কপি মানেই কি হুবহু মানুষ?
না। ডিএনএ’র কপি করলেই মানুষ হুবহু হবে না। কারণ:
-
চিন্তা, আবেগ ও স্মৃতি কোনো কোডে রাখা যায় না
-
চরিত্র ও ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠে অভিজ্ঞতার মাধ্যমে
-
স্বকীয়তা মানুষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য — যা নকল করা অসম্ভব
৯.৩. উপসংহার:
একজন মানুষের থেকে আরেকজন হুবহু মানুষ তৈরি করা বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে কিছুটা সম্ভব — অন্তত শরীরগত দিক থেকে। তবে তার মন, অভ্যাস, অনুভূতি, স্মৃতি ও ব্যক্তিত্ব হুবহু হওয়া সম্ভব নয়। ক্লোন মানেই “একই মানুষ” নয় — সে নিজেই হবে একটি ভিন্ন ও স্বাধীন সত্তা।
অতএব, বিজ্ঞান আমাদের সামনে এক নতুন পথ খুলে দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেই পথ ধরে হাঁটতে হলে আমাদের বিবেচনা করতে হবে নৈতিকতা, মানবতা ও সামাজিক প্রভাব—এই তিনটি স্তম্ভের আলোকে।
0 Comments