6/recent/ticker-posts

রক্তের গ্রুপ কী? কেন জমাট বাঁধে?

 

রক্তের গ্রুপ কী?

 রক্তের গ্রুপ বা রক্তের ধরন মূলত রক্তে উপস্থিত কিছু নির্দিষ্ট অ্যান্টিজেন ও অ্যান্টিবডির ওপর ভিত্তি করে নির্ধারিত হয়। মানুষের রক্ত প্রধানত দুটি প্রধান পদ্ধতিতে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়:

  1. ABO সিস্টেম
  2. Rh সিস্টেম (Rhesus Factor)

এই দুইটি সিস্টেম মিলিয়ে মানুষের রক্ত চারটি প্রধান গ্রুপে বিভক্ত হয়: A, B, AB, ও O। প্রতিটি গ্রুপ আবার Rh ধনাত্মক (+) বা ঋণাত্মক (–) হতে পারে। যেমন: A+, B–, AB+, O– ইত্যাদি।


রক্তে কী থাকে?

রক্তের প্রধান উপাদান চারটি:

  1. রেড ব্লাড সেল (লাল রক্ত কণিকা)
  2. হোয়াইট ব্লাড সেল (সাদা রক্ত কণিকা)
  3. প্লাজমা
  4. প্লেটলেট

রেড ব্লাড সেলের গায়ে বিশেষ ধরনের প্রোটিন জাতীয় অ্যান্টিজেন থাকে, আর প্লাজমাতে থাকে অ্যান্টিবডি। এই অ্যান্টিজেন এবং অ্যান্টিবডির ভিত্তিতে রক্তের গ্রুপ নির্ধারিত হয়।


রক্তের গ্রুপ নির্ধারণের পদ্ধতি

রক্তের গ্রুপ নির্ধারণ করতে ডাক্তার বা ল্যাব টেকনিশিয়ানরা সাধারণত "অ্যাগলুটিনেশন টেস্ট" নামক একটি পরীক্ষার মাধ্যমে কাজ করেন। এটি একটি সহজ, দ্রুত এবং নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি।

ধাপ ১: রক্ত সংগ্রহ

সাধারণত হাতের বা আঙুলের ডগা থেকে কয়েক ফোঁটা রক্ত সংগ্রহ করা হয়।

ধাপ ২: রক্তের নমুনা তিনটি আলাদা কাঁচের স্লাইডে বা বিশেষ প্লেটে রাখা হয়।

প্রতিটি স্লাইডে বা প্লেটে তিনটি জায়গায় রক্তের ফোঁটা রাখা হয়। তারপর প্রতিটি জায়গায় আলাদাভাবে নিচের প্রতিক্রিয়াগুলি পরীক্ষা করা হয়:

  • Anti-A অ্যান্টিসিরাম (এটি A অ্যান্টিজেন সনাক্ত করে)
  • Anti-B অ্যান্টিসিরাম (এটি B অ্যান্টিজেন সনাক্ত করে)
  • Anti-D অ্যান্টিসিরাম (Rh ফ্যাক্টর চিহ্নিত করে)

ধাপ ৩: প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ

রক্তের ফোঁটার সঙ্গে অ্যান্টিসিরাম মিশিয়ে তার প্রতিক্রিয়া (clumping বা জমাট বাঁধা) লক্ষ্য করা হয়।

  • যদি Anti-A সিরামের সঙ্গে জমাট বাঁধে → রক্তে A অ্যান্টিজেন আছে → A গ্রুপ
  • যদি Anti-B সিরামের সঙ্গে জমাট বাঁধে → B অ্যান্টিজেন আছে → B গ্রুপ
  • যদি দুটোর সঙ্গেই জমাট বাঁধে → A ও B উভয় অ্যান্টিজেন আছে → AB গ্রুপ
  • যদি কোনোটার সাথেই জমাট না বাঁধে → কোনো অ্যান্টিজেন নেই → O গ্রুপ

Rh ফ্যাক্টর:

  • যদি Anti-D সিরামের সঙ্গে জমাট বাঁধে → Rh পজিটিভ (ধনাত্মক)
  • যদি জমাট না বাঁধে → Rh নেগেটিভ (ঋণাত্মক)

উদাহরণ দিয়ে বোঝানো যাক

ধরি একজন ব্যক্তির রক্তের তিনটি ফোঁটার সঙ্গে তিনটি অ্যান্টিসিরাম মেশানো হলো:

  • Anti-A সিরামের সঙ্গে জমাট বাঁধল ✅
  • Anti-B সিরামের সঙ্গে জমাট বাঁধেনি ❌
  • Anti-D সিরামের সঙ্গে জমাট বাঁধল ✅

উপসংহার:

  • এ ব্যক্তির রক্তে A অ্যান্টিজেন আছে (Anti-A তে প্রতিক্রিয়া), B নেই, আর Rh ধনাত্মক।
  • অর্থাৎ তার রক্তের গ্রুপ A+

কেন জমাট বাঁধে?

জমাট বাঁধা (Agglutination) হয় যখন অ্যান্টিজেন ও অ্যান্টিবডি পরস্পরের সঙ্গে মিশে গিয়ে একে অপরকে প্রতিক্রিয়া করে। এই প্রতিক্রিয়ার ফলে রক্তের কণিকাগুলো জোট বাঁধে বা ক্লাম্প তৈরি করে। এটি সহজেই মাইক্রোস্কোপে বা খালি চোখে দেখা যায়।


রক্তের গ্রুপ জানার গুরুত্ব

  1. রক্তদান ও গ্রহণ: ভুল রক্ত গ্রুপের রক্ত দিলে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া হতে পারে, এমনকি মৃত্যুও হতে পারে।
  2. গর্ভাবস্থা: Rh ফ্যাক্টরের কারণে অনেক সময় মা ও গর্ভের সন্তানের রক্তের মধ্যে সমস্যা দেখা দিতে পারে।
  3. অপারেশন বা দুর্ঘটনা: জরুরি অবস্থায় দ্রুত রক্ত দরকার হলে রক্তের গ্রুপ জানা থাকাটা জীবন বাঁচাতে পারে।
  4. পিতৃত্ব নির্ধারণ: কিছু ক্ষেত্রে রক্তের গ্রুপ দেখে সম্ভাব্য পিতা নির্ধারণ করা যায়।

আধুনিক প্রযুক্তিতে রক্ত পরীক্ষা

বর্তমানে অনেক আধুনিক স্বয়ংক্রিয় মেশিন আছে যা অল্প সময়েই রক্তের গ্রুপ শনাক্ত করতে পারে। তবে মূল পদ্ধতিটি একই থাকে – অ্যান্টিজেন ও অ্যান্টিবডির প্রতিক্রিয়া নিরীক্ষণ।


উপসংহার

রক্তের গ্রুপ নির্ধারণ একটি সহজ কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া। ডাক্তার বা ল্যাব টেকনিশিয়ানরা অ্যান্টিসিরাম ব্যবহার করে রক্তে জমাট বাঁধার প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করেই নির্ধারণ করেন কার রক্ত কোন গ্রুপের। এই পদ্ধতি বিজ্ঞানসম্মত, পরীক্ষিত এবং বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্য। প্রতিটি মানুষের উচিত নিজের রক্তের গ্রুপ জানা, কারণ এটি জীবনের কোনো এক সময়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।

Post a Comment

0 Comments