6/recent/ticker-posts

মার্ক জুকারবার্গের জীবনী: সাফল্যের পেছনের গল্প

 

মার্ক জুকারবার্গের জীবনী: সাফল্যের পেছনের গল্প


 

ভূমিকা

বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত এবং প্রভাবশালী প্রযুক্তি উদ্যোক্তাদের একজন হচ্ছেন মার্ক এলিয়ট জুকারবার্গ। তিনি শুধু একটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের (Facebook) প্রতিষ্ঠাতা নন, বরং আধুনিক ডিজিটাল দুনিয়ার পথিকৃতদের অন্যতম। তাঁর জীবন কেবল সফল উদ্যোক্তা হবার গল্প নয়, বরং এক স্বপ্ন দেখা তরুণের অবিচল পরিশ্রম, অধ্যবসায় ও দূরদর্শিতার এক অনন্য উদাহরণ। এই প্রবন্ধে আমরা বিস্তারিতভাবে জানব তাঁর শৈশব থেকে শুরু করে ফেসবুকের প্রতিষ্ঠা, বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ, ব্যক্তিগত জীবন, এবং তাঁর সাফল্যের মূল রহস্যগুলো।


শৈশব ও প্রাথমিক জীবন

মার্ক এলিয়ট জুকারবার্গ জন্মগ্রহণ করেন ১৯৮৪ সালের ১৪ মে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কের হোয়াইট প্লেইনস শহরে। তাঁর বাবা এডোয়ার্ড জুকারবার্গ একজন দন্তচিকিৎসক এবং মা ক্যারেন ছিলেন একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। জুকারবার্গ পরিবার ছিল বুদ্ধিবৃত্তিক পরিবেশে গড়া একটি মধ্যবিত্ত ইহুদি পরিবার।

মার্ক ছোটবেলা থেকেই প্রযুক্তি এবং প্রোগ্রামিংয়ের প্রতি গভীর আগ্রহ দেখিয়েছেন। মাত্র ১২ বছর বয়সে তিনি "ZuckNet" নামে একটি মেসেজিং প্রোগ্রাম তৈরি করেন, যা তাঁর বাবা ব্যবহার করতেন অফিসে এবং বাড়িতে যোগাযোগ রক্ষার জন্য। তাঁর এই প্রতিভা দেখে অনেকেই তাকে ‘প্রোগ্রামিং প্রডিজি’ নামে ডাকতে শুরু করেন।


শিক্ষা ও হার্ভার্ড যাত্রা

জুকারবার্গ পড়াশোনা করেন ফিলিপস এক্সেটার অ্যাকাডেমিতে, যা যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিখ্যাত প্রিপারেটরি স্কুল। সেখানে তিনি বিজ্ঞান ও ক্লাসিক্যাল বিষয়ের প্রতি বিশেষ আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। ২০০২ সালে তিনি ভর্তি হন হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে। হার্ভার্ডেই তিনি কম্পিউটার সায়েন্স এবং মনোবিজ্ঞানে অধ্যয়ন করেন।

হার্ভার্ডে পড়ার সময় তিনি একাধিক প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে CourseMatch এবং Facemash। Facemash ছিল একটি ওয়েবসাইট যেখানে ছাত্রদের ছবি দিয়ে রেটিং দেওয়া হতো। এই সাইটটি অনেক জনপ্রিয় হলেও এটি গোপনীয়তার জন্য বিতর্কের জন্ম দেয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সাইটটি বন্ধ করে দেয়।



ফেসবুকের জন্ম

২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে, জুকারবার্গ তাঁর রুমমেটদের (ডাস্টিন মোস্কোভিটজ, ক্রিস হিউজ, এডুয়ার্ডো স্যাভেরিন) সহায়তায় "The Facebook" নামে একটি সাইট চালু করেন, যা শুরুতে শুধুমাত্র হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের জন্য উন্মুক্ত ছিল। এই সাইটের লক্ষ্য ছিল ব্যবহারকারীরা তাদের প্রোফাইল তৈরি করে একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত হতে পারবে।

খুব দ্রুতই ফেসবুক অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে ছড়িয়ে পড়ে। ২০০৪ সালের শেষের দিকে, সিলিকন ভ্যালির বিনিয়োগকারী পিটার থিয়েল জুকারবার্গের স্টার্টআপে বিনিয়োগ করেন। এরপর ধাপে ধাপে ফেসবুক বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় হতে শুরু করে।

২০০۵ সালে ‘The’ শব্দটি বাদ দিয়ে এর নাম রাখা হয় ‘Facebook’। পরবর্তীতে এটি সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়, এবং প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ নতুন ব্যবহারকারী এতে যোগ দিতে থাকে।



ফেসবুকের দ্রুত উত্থান ও চ্যালেঞ্জ

ফেসবুক শুধু একটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নয়; এটি হয়ে ওঠে একটি বৈশ্বিক যোগাযোগ নেটওয়ার্ক। ২০০৮ সালের মধ্যে এটি বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতবর্ধনশীল ওয়েবসাইটে পরিণত হয়। ২০১২ সালে ফেসবুকের ব্যবহারকারীর সংখ্যা এক বিলিয়ন ছাড়িয়ে যায়।

তবে ফেসবুকের যাত্রাপথ সহজ ছিল না। এটি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই অনেক প্রতিযোগিতা, আইনি সমস্যা এবং গোপনীয়তার অভিযোগের সম্মুখীন হয়েছে। হার্ভার্ডের দুই সহপাঠী ক্যামেরন এবং টাইলর উইঙ্কলভস দাবি করেন, ফেসবুকের ধারণা মূলত তাদের আইডিয়া ‘HarvardConnection’ থেকে চুরি করা হয়েছে। এই বিতর্ক আদালত পর্যন্ত গড়ায় এবং শেষ পর্যন্ত বিষয়টি সমঝোতার মাধ্যমে নিষ্পত্তি হয়।


ব্যবসা সম্প্রসারণ ও অধিগ্রহণ

ফেসবুককে কেবল সামাজিক প্ল্যাটফর্ম হিসেবে সীমাবদ্ধ না রেখে, জুকারবার্গ এটিকে এক বিশাল প্রযুক্তি সাম্রাজ্যে পরিণত করেছেন। তিনি সময়ের চাহিদা ও প্রতিযোগিতাকে উপলব্ধি করে একের পর এক স্ট্র্যাটেজিক অধিগ্রহণ করেন:

  • Instagram (2012): ১ বিলিয়ন ডলারে ইনস্টাগ্রাম অধিগ্রহণ করে ফেসবুক তার ফটো শেয়ারিং সেবা শক্তিশালী করে তোলে।
  • WhatsApp (2014): প্রায় ১৯ বিলিয়ন ডলারে হোয়াটসঅ্যাপ কেনা হয়, যা বিশ্বের বৃহত্তম মেসেজিং অ্যাপগুলোর একটি।
  • Oculus VR (2014): ভার্চুয়াল রিয়েলিটি বাজারে প্রবেশের জন্য ওকুলাস ভিআর অধিগ্রহণ করে।

এইসব পদক্ষেপ প্রযুক্তি খাতে ফেসবুকের আধিপত্য আরও বাড়িয়ে তোলে এবং কোম্পানিটিকে গ্লোবাল টেক জায়ান্টে পরিণত করে।


ব্যক্তিগত জীবন

মার্ক জুকারবার্গ ২০১২ সালে তাঁর দীর্ঘদিনের প্রেমিকা প্রিসিলা চ্যানকে বিয়ে করেন। তাঁরা হার্ভার্ডেই একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হন। এই দম্পতির দুটি কন্যা সন্তান রয়েছে। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি খুবই সাধারণ জীবনযাপন পছন্দ করেন। অধিকাংশ সময় তিনি সাধারণ পোশাক পরেন এবং অতিরিক্ত বিলাসিতা এড়িয়ে চলেন।

তিনি এবং তাঁর স্ত্রী ‘Chan Zuckerberg Initiative’ (CZI) নামে একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠান গঠন করেন। এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তাঁরা শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, বিজ্ঞান এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের উন্নয়নে কাজ করছেন। ২০১৫ সালে, মেয়ের জন্ম উপলক্ষে, তাঁরা ঘোষণা দেন যে তাঁদের সম্পদের ৯৯% এই দাতব্য খাতে ব্যয় করবেন।



মেটা ও ভবিষ্যতের প্রযুক্তি

২০২১ সালে ফেসবুক ইনকর্পোরেটেড তার নাম পরিবর্তন করে রাখে Meta Platforms Inc.। এর মাধ্যমে জুকারবার্গ ভবিষ্যতের ইন্টারনেট অর্থাৎ ‘Metaverse’ এর দিকে অগ্রসর হওয়ার পরিকল্পনা প্রকাশ করেন। মেটাভার্স এমন একটি ভার্চুয়াল জগৎ যেখানে মানুষ ভার্চুয়াল বাস্তবতায় (VR) একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ, কাজ, ও বিনোদন উপভোগ করতে পারবে।

যদিও মেটাভার্স প্রজেক্টের ভবিষ্যৎ এখনো অনিশ্চিত, জুকারবার্গ এর প্রতি বিশাল বিনিয়োগ করেছেন এবং এটিকে ভবিষ্যতের বড় প্রযুক্তি বিপ্লব হিসেবে দেখছেন।


সাফল্যের মূল রহস্য

মার্ক জুকারবার্গের সাফল্যের পেছনে কয়েকটি মূল কারণ রয়েছে:

  1. প্রযুক্তি সম্পর্কে প্রগাঢ় আগ্রহ: ছোটবেলা থেকেই প্রযুক্তির প্রতি তার ভালোবাসা এবং আগ্রহ তাঁকে এগিয়ে নিয়ে গেছে।
  2. উদ্যোগ ও ঝুঁকি নেওয়ার সাহস: কলেজ থেকে ড্রপআউট হয়ে নিজের কোম্পানিতে মনোনিবেশ করা সহজ ছিল না, কিন্তু তিনি সাহস করেছিলেন।
  3. দূরদর্শী চিন্তাভাবনা: তিনি সবসময় ভবিষ্যতের প্রযুক্তি ও মানুষের প্রয়োজনীয়তা চিন্তা করে কাজ করেন।
  4. দল গঠন ও নেতৃত্ব: ভালো টিম তৈরি করা এবং নেতৃত্ব দেওয়ার অসাধারণ ক্ষমতা তাঁর সফলতা ত্বরান্বিত করেছে।
  5. নতুন কিছু শেখার খিদে: তিনি আজও প্রতিদিন কিছু না কিছু শেখার চেষ্টা করেন, যা তাঁকে আরও দক্ষ করে তুলছে।

🧬 মার্ক জুকারবার্গের জীবনের টাইমলাইন

১৯৮৪ – জন্মগ্রহণ করেন নিউ ইয়র্কের হোয়াইট প্লেইনসে।
১৯৯৬ – মাত্র ১২ বছর বয়সে তৈরি করেন "ZuckNet" মেসেজিং প্রোগ্রাম।
২০০২ – হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন।
২০০৪ – "The Facebook" চালু করেন, যা পরে "Facebook" নামে পরিচিত হয়।
২০০৫ – ফেসবুকের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় "Facebook"।
২০১২ – ফেসবুক পাবলিক কোম্পানি হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়।
২০১৪ – ইনস্টাগ্রাম ও হোয়াটসঅ্যাপ অধিগ্রহণ করেন।
২০১৫ – "Chan Zuckerberg Initiative" প্রতিষ্ঠা করেন।
২০২১ – ফেসবুকের নাম পরিবর্তন করে "Meta Platforms" রাখা হয়।
বর্তমান – মেটাভার্স ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ অব্যাহত রেখেছেন।সমালোচনা ও বিতর্ক

মার্ক জুকারবার্গের পথচলা সবসময় প্রশংসায় ভরা ছিল না। তাঁর কোম্পানি বহুবার গোপনীয়তা লঙ্ঘন, ভুয়া খবর ছড়ানো, রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার ইত্যাদি কারণে সমালোচনার মুখে পড়েছে। বিশেষ করে কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা কেলেঙ্কারিতে ফেসবুকের ব্যবহারকারীর তথ্য অপব্যবহারের অভিযোগ উঠে আসে, যা বিশ্বজুড়ে বিতর্ক তৈরি করে।

এমন পরিস্থিতিতে জুকারবার্গকে মার্কিন কংগ্রেসের সামনে হাজির হয়ে জবাব দিতে হয়। তবে সমালোচনা সত্ত্বেও, তিনি নিজের অবস্থানে দৃঢ় থেকেছেন এবং পরিবর্তনের জন্য নানা পদক্ষেপ নিয়েছেন।


উপসংহার

মার্ক জুকারবার্গ একজন অনুপ্রেরণাদায়ক চরিত্র, যিনি বিশ্বকে যোগাযোগের নতুন এক যুগে নিয়ে গেছেন। তাঁর জীবন প্রমাণ করে যে প্রযুক্তি ও সৃষ্টিশীলতার মিল হলে একজন ব্যক্তি গোটা দুনিয়াকে বদলে দিতে পারেন। সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি, পরিশ্রম, এবং মানুষের চাহিদা বোঝার দক্ষতা থাকলে, যে কেউ মার্ক জুকারবার্গের মতো হয়ে উঠতে পারে।

Post a Comment

0 Comments